ছেঁচকি (Chenchki) বাংলাদেশের এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি জনপ্রিয় ও প্রাচীন তরকারি রান্নার ধরন। এটি মূলত অল্প তেলে, সরষে বা পোস্ত বাটা দিয়ে, কম মসলা ব্যবহার করে রান্না করা একধরনের শুকনো তরকারি। ছেঁচকির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর সরলতা ও স্বাদ। যে কোনো একটি বা একাধিক শাকসবজি, যেমন কুমড়ো, বেগুন, উচ্ছে, আলু, কাঁচা কলা, ঝিঙ্গে, করলা ইত্যাদি দিয়ে ছেঁচকি রান্না করা যায়। কখনো কখনো শুকনো লঙ্কা ও পঞ্চফোড়নের ব্যবহার ছেঁচকিতে আলাদা ঘ্রাণ ও স্বাদ নিয়ে আসে। ছেঁচকি সাধারণত ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয় এবং এটি উপবাস বা হালকা খাবারের সময়ে খুব জনপ্রিয়।
ছেঁচকি রান্নার ক্ষেত্রে তেলের ব্যবহার কম হয় এবং এতে প্রক্রিয়াজাত মসলা কম ব্যবহৃত হয়, ফলে এটি স্বাস্থ্যকর একটি খাবার হিসেবেও পরিচিত। এটি নিরামিষ রান্নার একটি অনন্য উদাহরণ, যদিও কিছু অঞ্চলে ছেঁচকিতে শুকনো চিংড়িও ব্যবহার করা হয়। ছেঁচকি শুধু স্বাদের জন্যই নয়, বরং তার পুষ্টিগুণ ও হজমে সহায়ক বৈশিষ্ট্যের জন্যও প্রসিদ্ধ।
উপকরণ
১. লাউ, আলু, সজনে ডাটা, মিষ্টি কুমড়া, মূলা, সিম, বরবটি, পেঁয়াজ পাতা, বেগুন
২. পেঁয়াজ বাটা, মরিচ বাটা, অল্প আদা রসুন বাটা (দিতে পারেন আবার নাও দিতে পারেন)
৩. হলুদ বাটা, লবণ, তেজপাতা ও সামান্য চিনি
প্রস্তুত প্রণালি
ছেঁচকিতে মশলা কম পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়। ছেঁচকিতে তরকারী সাইজ মত টুকরা করে নিতে হবে ও বেশী সিদ্ধ করতে হবে, যেন তরকারী ভেঙ্গে যায়। তেলে পেঁয়াজ কুচি ভেজে অথবা সরিষা, পাঁচফোড়ন, জিরা শুকনা মরিচ ইত্যাদি ফোড়ন দিয়ে সিদ্ধ তরকারি মশলা সহ দিতে হবে। নামানোর পূর্বে সামান্য চিনি দিয়ে নামাতে হবে।
লাউ-এর ছেঁচকিতে লাউ সরু ও পাতলা করে কাটতে হবে ও এতে সরিযা ও শুকনা মরিচ এর ফোড়ন দিতে হবে।
সজনে ডাটার ছেঁচকিতে সজনে প্রথমত পানি দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হবে। সজনে ডাটার ছেঁচকিতে সরিষা ও শুকনা মরিচ ফোড়ন দেবেন। অর্থাৎ গরম তেলে শুকনা মরিচ ও সরিষা ফোড়ন দিয়ে মশলা সহ সিদ্ধ সজনে দেবেন। এতে বাটা সরিষা সামান্য পানিতে গুলে দেবেন।
মিষ্টি কুমড়ার ছেঁচকিতে কুমড়া সরু ও পাতলা করে কাটবেন। পরে গরম তেলে শুকনা মরিচ ও কালো জিরা ফোড়ন দিয়ে কুমড়া দেবেন। নামাবার পূর্বে চিনি দেবেন। এতে কুমড়া মাখা মাখা ও ভাঙ্গা ভাঙ্গা হবে।
ছেঁচকি শুধু একটি রেসিপি নয়, বরং বাঙালি রান্নার এক পরিমিত সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। ঘরে থাকা উপকরণ দিয়ে খুব সহজে রান্না করা একটি খাবার। তেল, মসলা কম হওয়ায় এটি হালকা খাবার হিসেবে খুবই উপযোগী, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে। ছেঁচকিতে সাধারণত রান্না করা হয় পঞ্চফোড়ন বা সরষে ফোড়ন দিয়ে, যা এর স্বাদ ও ঘ্রাণে আলাদা মাত্রা যোগ করে।
ছেঁচকি তৈরিতে অনেক সময় এমন সবজি ব্যবহৃত হয় যেগুলো অন্য রেসিপিতে খুব একটা ব্যবহার হয় না, যেমন করলা, উচ্ছে বা কাঁচা কলা—এগুলো ছেঁচকিতে অসাধারণ রূপ পায়। যারা উপবাস পালন করেন, তাঁদের জন্য নিরামিষ ছেঁচকি একটি আদর্শ খাদ্য।
এটি শুধু বাঙালির রান্না নয়, বরং বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির এক অনন্য অংশ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছেঁচকি হয়ে উঠেছে প্রতিদিনের পাতে মাটির গন্ধ মেশানো এক সাদামাটা অথচ অসাধারণ স্বাদের অনুভব। সহজ রান্না, পুষ্টিকর গুণ, আর হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ঘ্রাণ—এই সবকিছু মিলেই ছেঁচকিকে করেছে চিরকালীন প্রিয়।